গত প্রকাশনার মাধ্যমে আশাকরি আপনারা লিনাক্স সম্পর্কে ধারনা পেয়েছেন। অনেকেই হয়ত জানেন লিনাক্স একটি ওপেন সোর্স সফটওয়্যার। মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, ওপেন সোর্স মানে কি? ওপেন সোর্স কোথা থেকে এলো? অথবা লিনাক্সের সাথে ওপেন সোর্সের সম্পর্কটাই বা কি?
শুরু করা যাক একটা ছেলেকে নিয়ে; ১৯৬৯ সালে সাংবাদিক দম্পতি নিল্স ও এ্যানার ঘরে জন্ম নেয় একটি ফুটফুটে সোনালী চুলের ছেলে। নোবেল প্রাইজ বিজয়ী আমেরিকান কেমিস্ট “লিনুস পলিং” এর নাম অনুসারে তারা ছেলেটির নাম রাখেন লিনুস বেনেডিক্ট টরভাল্ডস। ছেলেটির দাদা ছিলেন কবি ও সাংবাদিক। ছেলেটি সাংবাদিক ঘরানার দেখে অনেকেই ভেবে নিতে পারেন ছেলেটিও লেখালেখিকে আপন করে নিবে। সে লেখা লেখির জগৎ টাকে আপন করে নিলেও তা ছিলো অন্য রকমের। অর্থাৎ কোড লেখালেখিকে সে আপন করে নিয়েছিলো, তাতেই ছিলো তার মূল আনন্দ। অন্যান্য ছেলেদের মত খেলাধুলাতে তার কম আগ্রহ ছিলো। অন্যদের ছেলেদের সাথে মিশতেও আগ্রহ তার কম ছিলো। তার দাদার দেওয়া পার্সোনাল কম্পিউটার (কমোডোর ভিআইসি টুয়েন্টি) দিয়ে সে টুকিটাকি প্রোগ্রামিং এর কাজ করতো। প্রোগ্রামিংই ছিলো তার জীবনের বড়ো একটি অংশ।
সময়টা ১৯৯১ সাল, তখন লিনুস হেলসিংকি ইউনিভার্সিটির দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। সেসময়ে লিনুস আইবিএম এর ইন্টেল ৩৮৬ প্রসেসরের একটি পার্সোনাল কম্পিউটার কিনে। কম্পিউটারটির সাথে বিল্টইন এমএস ডস অপারেটিং সিস্টেম ইন্সটল করা ছিলো। সে এমএস ডস ব্যবহার করে পুরাপুরি হতাশ হয়ে পড়লো, কারন ইন্টেলের এই প্রসেসরটির সম্পুর্ণ ব্যবহার করার ক্ষমতা সেটির ছিলোনা। সে তার ভার্সিটিতে ইউনিক্স অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার করত। নিজের পিসিতে ও ভার্সিটির পিসিতে একই অপারেটিং সিস্টেম থাকলে কাজ করতে সুবিধা হবে ভেবে সে ইউনিক্স কেনার চেষ্টা করে। কিন্তু তখনকার বাজার দরে ইউনিক্সের মুল্য ৫০০০ ডলার হওয়ায় সে ইউনিক্সের আশা ছেড়ে দেয়।
কিছুসময় পর সে মিনিক্স নিয়ে চিন্তা ভাবনা শুরু করে। মিনিক্স ছিলো ডাচ প্রফেসর এন্ড্রু টনেনবমের লেখা ইউনিক্সের মতই একটি অপারেটিং সিস্টেম। বলে রাখা ভালো এটি ছিলো ইউনিক্সের ক্লোন, তাও আবার পুরোপুরি ক্লোন নয়। প্রফেসর সাহেব অপারেটিং সিস্টেমের ভেতরের খুটিনাটি ছাত্রদের বোঝানোর সময় মিনিক্স ব্যবহার করতেন। এর একটা সুবিধা ছিলো প্রফেসর সাহেবের লেখা “অপারেটিং সিস্টেমঃ ডিজাইন এন্ড ইম্পলিমেন্টেশন” বই টি কিনলে তার সাথে মিনিক্সের ১২০০০ লাইনের সোর্স কোড পাওয়া যেতো। তবে অসুবিধে ছিলো এটির লাইসেন্সে এটিকে পরিবর্তন, পরিবর্ধন, পরিমার্জন করার অনুমতি দেওয়া ছিলো না।
তাছাড়া সম্পুর্ণ অপারেটিং সিস্টেম বলতে যা বোঝায় তা এটি ছিলোনা, এটি ছিলো ছাত্রদের শিক্ষা দেওয়ার একটি উপকরন মাত্র। তবুও লিনুস সেই বই টি কিনে ফেলল। কেনার পর সে টের পেলো মিনিক্স তার চাহিদা পুরন করতে সক্ষম না। তারপর সে এক ভয়ানক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল, যা পরবর্তীতে তার জীবন এমনি কি গোটা পৃথিবী কে পাল্টে দেয়। সিদ্ধান্ত টি হলো সে মিনিক্স আর ইউনিক্সের আদলে সম্পুর্ণ নতুন একটি অপারেটিং সিস্টেম তৈরী করবে।
সাধারণ মানুষ তখন টাকা দিয়ে সফটওয়্যার কিনে সেটিকে ব্যবহার করতে পারত। এর সোর্স কোড নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে গেলে পড়ে যেতো “কপিরাইট” নামক আইনের ঝামেলায়। অর্থাৎ আপনার টাকা থাকলে আপনি সফটওয়্যার কিনে ব্যবহার করতে পারবেন, অথবা সফটওয়্যার ব্যবহারের কোন অধিকার আপনার নেই।
স্টলম্যানের তখন এইসব ধরা বাধা পছন্দ ছিলো না। তার কথা হচ্ছে সফটওয়্যার হতে হবে মুক্ত, বিনামূল্যে ও আইনের ধরাবাধা বিহীন। যেন সবাই সফটওয়্যার কে নিজের মত করে সাজিয়ে নিয়ে ব্যবহার করতে পারে। এতে অবশ্য সফটওয়্যারটির লাভই বেশি, কারন সেটির উন্নয়ন আরো দ্রুততর হবে।
স্টলম্যান তার মত চিন্তা ভাবনার মানুষজন কে নিয়ে শুরু করলেন একটি সঙ্গঠন, যার নাম দিলেন GNU (গ্নু)। তিনি ও তার সংগঠন মুক্ত সফটওয়্যার লেখার কাজে নেমে পড়লেন। কিন্তু সফটওয়্যারের সাথে সাথে তারা একটি অপারেটিং সিস্টেমের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে লাগলেন। কিন্তু অপারেটিং সিস্টেম তৈরীর জন্য আরো সফটওয়্যার দরকার, বিশেষ করে একটি কম্পাইলার তো অতি জরুরী। তিনি অল্প দিনেই একটি কম্পাইলার লেখার কাজ শেষ করেন। যার নাম দিলেন গ্নু সি কম্পাইলার যাকে আমরা জিসিসি (GCC) নামে চিনি। জিসিসি নামক অস্ত্র হাতে নিয়ে তিনি নেমে পড়লেন কার্নেল লেখার কাজে। এই সময়ে তিনি গ্নু হার্ড (GNU/HURD) নামক একটি কার্নেল তৈরীও করে ফেলেন। কিন্তু সেটি ডেভেলপারদের মাঝে তেমন সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়নি।
যাই হোক, তখনও ওপেন সোর্স সফটওয়্যার আন্দোলন সফল হওয়ার জন্য সবচেয়ে দরকারী ছিলো একটি অপেন সোর্স অপারেটিং সিস্টেম, যার জন্য দরকারী ছিলো একটি ওপেন সোর্স কার্ণেল।
এখন আমরা ফিরে আসতে পারি লিনুস নামক ছেলেটির গল্পে। সে অপারেটিং সিস্টেমে যোগ করল স্টলম্যানের গ্নু ব্যাশ শেল (টেক্স বেজড ইন্টারফেস তৈরীর জন্য) আর গ্নু সি কম্পাইলার (কম্পাইলার হিসেবে)। সে চাইলো তার এই অপারেটিং সিস্টেম সম্পর্কে মিনিক্স ইউজার গ্রুপে জানাতে। কিন্তু মনে ভয় কাজ করছিলো, যাতে আবার সকলের হাসির পাত্র না হয়ে যায়। আবার সে এটাও বুঝতে পারছিলো সবাইকে জানালে হয়ত সে তার অপারেটিং সিস্টেমের ব্যাপারে সাহায্য পাবে। অবশেষ লিনুস গ্রুপে একটি ইমেইল পোষ্ট করেই ফেলল। পোষ্ট করার পর সে অকল্পনীয় সাড়া পেলো। লিনুস নামক ভার্সিটি পড়ুয়া ছেলেটির শখের বশে তৈরী অপারেটিং সিস্টেম গোটা পৃথিবীতে বিশাল পরিবর্তন আনবে তা হয়ত সে নিজেও কল্পনা করতে পারেনি।
১৯৯১ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সেই অপারেটিং সিস্টেমের ০.০১ ভার্শন বের হয়। ধিরে ধিরে অন্য ডেভেলপাররা জড়ো হতে থাকে। তারা সেই অপারেটিং সিস্টেমটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে থাকে। তারা নিজের সুবিধা মতো পরিবর্তন, পরিবর্ধন করে পরবর্তী ভার্শনটি লিনুস কে পাঠাতে থাকে। সেই বছরেই ৫ই অক্টোবর লিনুসের অপারেটিং সিস্টেমের প্রথমবার অফিসিয়াল ভাবে মুক্তি দেওয়া হয়, যার ভার্শন ছিলো ০.০২। কয়েক সপ্তাহ পর বের হলো ভার্শন ০.০৩। সেই বছরের ডিসেম্বরেই মুক্তি পায় ভার্শন ০.১০।
তারপর থেকে এখন পর্যন্ত চলছেই সেই যাত্রা। প্রতি রিলিজে সেটি আরো উন্নত হচ্ছে। কয়েক লাইনে লেখা কোড টি এখন কয়েক মিলিয়নে গিয়ে দাড়িয়েছে, প্রতিসপ্তাহে গড়ে হাজার হাজার নতুন লাইন যুক্ত হচ্ছে।
এবার আসা যাক অপারেটিং সিস্টেমটির নাম করনে। লিনুসের ইচ্ছে ছিলো তার অপারেটিং সিস্টেমের নাম হবে “ফ্রিক্স” (Freaks) যা “Free”, “Freak” আর “Unix” তিনটা শব্দের সম্মিলিত একটি রুপ। কিন্তু তার বন্ধু ও সহকর্মী এ্যারি লোঙ্কের নামটি পছন্দ হয়নি। সে ইউনিভার্সিটির এফটিপি সার্ভারে সেই ফাইল টি লিনাক্স নামক একটি ফেল্ডারে রেখে দিলো। সেই থেকে অপারেটিং সিস্টেমটির নাম হয়ে গেলো লিনাক্স। লিনাক্স মানে “linus’s Unix” (লিনুসের ইউনিক্স)।
আপনারা নিশ্চই লিনাক্সের লগো দেখেছেন? লগোটি কিভাবে এলো জানেন?
লিনুস একবার অবকাশে সাউদার্ন হোমিস্ফিয়ারে ছুটি কাটাতে গিয়ে একটি পেঙ্গুইনের কামড় খেয়েছিলো। সেই থেকে তার মাথায় পেঙ্গুইনের আইডিয়া আসে। একটি মোটাসোটা পেঙ্গুইন ভুড়ি উচু করে দুই পা ছড়িয়ে মাটিতে বসে আছে। সেটাই হবে লিনাক্সের লোগো। অনেকেই আপত্তি দেখালেও এটি লিনুসের পছন্দ বলে কথা! এটিকে আমরা এখন টাক্স (Tux) নামে চিনি।
এই লেখাটি সম্পাদনা করা হয়েছে এপ্রিল ২২, ২০২০ ৬:৪৬ অপরাহ্ন
প্রোগ্রামিং শুরু করার আগে একটি প্রচলিত লাইন যা প্রায় সকল বিগিনারদের শুনতে হয়- "প্রোগ্রামিং খুব…
ডেনো কি? ডেনো হচ্ছে জাভাস্ক্রিপ্ট ও টাইপস্ক্রিপ্টের একটি সিকিউর রানটাইম, এটি জাভাস্ক্রীপ্টের V8 ইঞ্জিন এবং…
অনেকেরই ধারণা ইন্টারনেট মানে একটি ম্যাজিকেল ক্লাউড যা আমাদের পছন্দের ওয়েবসাইট, অনলাইন শপ এবং অন্তহীন…
ওয়েবের ৭৮.৯% ওয়েবসাইটই পিএইচপি তে রান হওয়া স্বত্বেও এটি ভবিষ্যতের ইকোসিস্টেমের সাথে যাচ্ছেনা। বিশেষ করে…
আমরা প্রত্যেকেই কম বেশি বিভিন্ন প্রয়োজনে সফটওয়্যার, ওয়েবসাইট এবং ওয়েব অ্যাপ ব্যবহার করে থাকি। এসকল…
ম্যালওয়্যার! বর্তমান সময়ে আসলেই একটি ভয়ের বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। বড় টেক কোম্পানী থেকে ছোট পার্সোনাল…