যেকোনো স্মার্ট ডিভাইস চলার জন্য সিস্টেম সফটওয়্যার এর প্রয়োজন হয়। সিস্টেম সফটওয়্যার হচ্ছে এমন কিছু যা পুরো ডিভাইসের সবরকম কাজ পরিচালনা করবে। সাধারণত এই ধরণের সফটওয়্যারকে ‘অপারেটিং সিস্টেম’ বলা হয়। যার মধ্যে মাইক্রোসফটের উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেম বেশী পরিচিত ও প্রচলিত একটি অপারেটিং সিস্টেম।
সাধারণত উইন্ডোজ – কম্পিউটার ও ল্যাপটপে বেশী ব্যবহৃত হয়, তবে মোবাইলেও এর অল্প পরিচিত রয়েছে। বর্তমানে মোবাইল প্ল্যাটফর্মে সবচেয়ে জনপ্রিয় অপারেটিং সিস্টেম হল – এন্ড্রয়েড। যার সত্ত্বাধিকারী প্রতিষ্ঠান হল গুগল, যা আমরা প্রায় সবাই জেনে থাকবো। মোবাইলের কথা যেহেতু বলেই ফেললাম তাহলে মূল প্রসঙ্গে আসা যাক…
লিনাক্স হল একটি ওপেন সোর্স অপারেটিং সিস্টেম কার্ণেল। ওপেন সোর্স বলতে বুঝায় যার সোর্স কোড সবার জন্য উন্মুক্ত ও এর পাশাপাশি নিজের মতো করে পরিবর্তন, পরিবর্ধন এবং সেটি নিজের নামে প্রকাশ করা যায়। উপরে যে এন্ড্রয়েডের কথা বলছিলাম, সেটি লিনাক্সে উপর ভিত্তি করে তৈরী করা হয়েছে।
লিনাক্স “অপারেটিং সিস্টেম”?
আসলে লিনাক্স উইন্ডোজ এর মতো কোনো অপারেটিং সফটওয়্যার নয়। অনেকজনকেই একথা বলতে শুনেছি যে, “আমি কম্পিউটারে লিনাক্স ব্যবহার করি”। তার মানে হলো তার পিসি লিনাক্স এর কোনো ডিসট্রিবিউশন -এ চলে। লিনাক্স আসলে একটি ‘অপারেটিং সিস্টেম কার্ণেল‘। যা ডিভাইস/হার্ডওয়্যার এর সাথে প্রোগ্রাম/সফটওয়্যার -এর সাথে মেলবন্ধণ তৈরী করে একটি কাজকে পূর্ণাঙ্গ সম্পন্ন করতে সহায়তা করে। ছোটকরে বললে কার্ণেল হচ্ছে হার্ডওয়্যারের সাথে সফটওয়্যারের সংযোগকারী।
লিনাক্স কার্ণেল এর সাথে প্যাকেজ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম, গ্নু টুলস ও অন্যান্য লাইব্রেরী যুক্ত হয়ে একটি লিনাক্স ডিসট্রিবিউশন/ডিস্ট্রো তৈরি হয়, যা আমরা অপারেটিং সিস্টেম মনে করে ব্যবহার করি। লিনাক্স ডিস্ট্রো সম্পূর্ণ ফ্রি ও ওপেনসোর্স হওয়ায় নিজের মতো কাস্টমাইজ করে ব্যবহার করার সুযোগ রয়েছে। যারা অপারেটিং সিস্টেমের আর্কিটেকচার ভালো বোঝেন ও প্রোগ্রামিং এ দক্ষ তারা চাইলে নিজেই লিনাক্স ডিস্ট্রো তৈরী করে ফেলতে পারেন।
বহুল ব্যবহৃত গ্নু্/লিনাক্স ডিস্ট্রো
ভিন্ন ভিন্ন কাজে ব্যবহার করার জন্য বিভিন্ন ধরণের লিনাক্স ডিস্ট্রো রয়েছে। ক্যাটাগরী আকারে প্রকাশ না করে বর্তমান সময়ে জনপ্রিয় কিছু লিনাক্স ডিস্ট্রো সম্পর্কে বলা হলো –
উবুন্টু – সবচেয়ে জনপ্রিয় ডিস্ট্রোর মধ্যে একটি। যারা নতুন লিনাক্স ব্যবহার শুরু করবেন ভাবছেন তাদের জন্য সবচেয়ে ভালো ডিস্ট্রো হচ্ছে উবুন্টু। এটি ব্যবহার করা অনেক বেশি সহজ এবং প্রায় সবরকম কাজ স্বাচ্ছন্দেই করা যায়।
ডেবিয়ান – শুধু ডেবিয়ানের উপর ভিত্তি করে ১৩৮ টিরও বেশী ডিস্ট্রো রয়েছে। আমরা যেই উবুন্টুকে আজ চিনি সেটির DNA হচ্ছে ডেবিয়ান। স্টেবল আর সিকিউরিটির দিক থেকে ডেবিয়ান বরাবরই অনেক বেশী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে লিনাক্স জগতে। নতুনদের জন্য খাপ খেয়ে নিতে ভালোই সময় লাগবে ডেবিয়ানে।
আর্চ লিনাক্স – ইউজার ফ্রেন্ডলি ও কাস্টমাইজেশন এর জন্য সুপরিচিত। যদি দীর্ঘসময় ধরে লিনাক্স ব্যবহার করার মনমানসিকতা থাকে, তাহলে আর্চ ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে নতুনদের জন্য আর্চ লিনাক্স দিয়ে লিনাক্স যাত্রা শুরু না করাটাই ভালো।
ওপেনসুসে – ডেভেলপার ও সিস্টেম এডমিনদের জন্য অধিক পছন্দের ডিস্ট্রো হচ্ছে এটি। দেখতে সুন্দর, সাজানো গোছানো এই ডিস্ট্রোটিকে কেউ চাইলে নিজের মতো করে একটি ভার্শন তৈরী করতে পারবে।
ফেডোরা – ডেভেলপারদের পছন্দ ও রেডহ্যাট লিনাক্সের কমিউনিটি নিয়ন্ত্রিত ডিস্ট্রো হচ্ছে ফেডোরা। লিনাক্স কার্ণেলের উদ্ভাবক “লিনুস টরভালস” এর পছন্দের ডিস্ট্রো এটি।
লিনাক্স ডিস্ট্রো ব্যবহারের সুবিধা
১। ফ্রি ও ওপেন সোর্স, এটি যেকোনো ডিভাইসে ব্যবহার করতে কাউকে মূল্য পরিশোধ করতে হয়না।
২। একটি অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার করতে যে ধরণের সফটওয়্যার থাকা প্রয়োজন তার সবটাই লিনাক্স ডিস্ট্রোতে দেওয়া থাকে। যেমন: ওয়েব ব্রাউজার, মিডিয়া প্লেয়ার, ফাইল ম্যানেজার সহ অন্যান্য।
৩। লিনাক্সে রয়েছে সবচেয়ে শক্তিশালী ম্যালওয়্যার থেকে সংরক্ষণ ব্যবস্থা, যার কারণে কোনো এন্টিভাইরাস সফটওয়্যার ব্যবহার করতে হয়না।
৪। ডেভেলপাররা আমাদের থেকে বেশী নিজেদের প্রাইভেসী নিয়ে সচেতন তাই তারা এটি এমন ভাবে তৈরী করেছে যাতে আমাদের কোনো হ্যাকারের কবলে পড়তে না হয়।
৫। লিনাক্সের যেকোনো ডিস্ট্রোই হার্ডওয়্যারের রিসোর্স অনেক কম পরিমাণে ব্যবহার করে থাকে, যার ফলে অনেক পুরাতন বা নূন্যতম কনফিগারেশনের পিসিতেও এটি দুর্দান্ত কাজ করে থাকে। তাছাড়া বিভিন্ন রকম লাইটওয়েট (হালকা) ডিস্ট্রো তো আছেই।
৬। লিনাক্স ভিত্তিক প্রতিটি ডিস্ট্রোর জন্য রয়েছে আলাদা আলাদা কমিউনিটি যেখানে সবরকম সমস্যার সমাধান ইতিমধ্যেই রয়েছে। কমিউনিটি সাপোর্টের জন্য অধিকাংশ ডিস্ট্রোই অনেক কম সময়ে মানুষের ভালোবাসায় পরিণত হয়েছে।
৭। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের ডেভেলপারদের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দিয়ে লিনাক্স ও ওপেন সোর্স সফটওয়্যার গুলো তৈরী হচ্ছে। তার মানে লিনাক্স আমাদের জন্য এবং আমাদের দ্বারাই তৈরী হচ্ছে, এর থেকে বড় সুবিধা আর কি হতে পারে!
কিছু ভূল ধারণা
অনেকেই মনে করে যে, লিনাক্স ব্যবহার করতে হলে কম্পিউটারে অনেক বেশী দক্ষতার প্রয়োজন হয় বা প্রোগ্রামিং জানতে হয় অথবা এটি অনেক জটিল কিছু ইত্যাদি। এটি সম্পূর্ণ নিজের তৈরীকৃত ভ্রান্ত ধারণা। যেকোনো বয়সের যেকোনো মানুষই লিনাক্স ব্যবহার করতে পারে এর জন্য উচ্চমানের প্রযুক্তি দক্ষতার প্রয়োজন হয়না।
একদল মানুষ এখনো মনে করেন যে, লিনাক্স ব্যবহার করা হয় শুধুমাত্র হ্যাকিং এর জন্য অথবা যে লিনাক্স ব্যবহার করে সে একজন হ্যাকার! আমার মতে এটিও একটি ভ্রান্ত ধারণা। এই প্রশ্নটি কতটুকু যুক্তিযুক্ত তা জানতে হলে আমাদের পরবর্তী ‘লিনাক্স’ বিষয়ক লেখাটি পড়তে হবে।
এই লেখাটি সম্পূর্ণ করতে সহযোগিতা করেছেন – সায়ীদ ইবনে মাসউদ এবং সম্পাদনা করেছেন – নাজির আহমেদ সাব্বির